পেশা হিসেবে আমার সাংবাদিকতার শুরু আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু অবশ্য তারও অনেক আগে। তবে সাংবাদিক হিসেবে খুব বড় ক্যারিয়ার ছিলো না। মাত্র বছর পাঁচেক ছিলাম মিডিয়ায়। অনেকটা হঠাৎ করেই ট্র্যাক চেঞ্জ করি। ১৯৯০ সালের ২০ নভেম্বর জয়েন করি ব্যাংকে।

২৯ বছর আগের সেই দিনটির কথা এখনো মনে পড়ে। তখন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছে। আমি যেদিন ব্যাংক যোগদান করবো সেদিনও ছিলো হরতাল। তখনকার হরতাল মানে আসলে সবকিছুই বন্ধ। তাই আজিমপুর থেকে হেঁটে হেঁটে দিলকুশা জীবন বীমা টাওয়ারে সিটি ব্যাংকের তখনকার হেড অফিসে পৌঁছাই।

আমার রিপোর্ট করার কথা ছিলো ১০টায়। আমি যাই ১২টায়। দেরী হওয়ার পেছনে হরতাল যেমন দায়ী, তেমনি ব্যাংকের ডিসিপ্লিন সম্পর্কে তখনো পর্যন্ত তেমন আইডিয়াও ছিলো না। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে টাইম-টেবিল তখন অতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো না। ব্যাংকে দেরীতে যাওয়ার বিষয়টিতেও সেই প্রতিফলন ছিলো।

প্রথম দিন ব্যাংকে যেতে আমার দেরী হচ্ছে। অন্যদিকে তখন এডমিন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ ফয়েজ, পরে তিনি এমডিও হয়েছেন, এই ভদ্রলোক আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘেমে গিয়েছেন। তখন মোবাইলের যুগও ছিলো না। তাই কোথায় আছি, তা-ও জানানোর কোনো উপায় ছিলো না। ফয়েজ সাহেব বারবার আশপাশের সহকর্মীদের কাছে আমার কথা জানতে চাইছিলেন। আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলেন- ‘এতো দেরী করেছো কেন?’ নিজেই উঠে গিয়ে টেবিল-চেয়ার দেখিয়ে দিলেন।

এখন মনে পড়লে নিজেরই হাসি পায়, প্রথমদিন স্যুট-টাই না পড়েই অফিসে গিয়েছি। ক্যাজুয়াল ড্রেসের কারণ ছিলো সেই সাংবাদিকতাই। একই কারণে প্রথমদিকে ৯-৫টা অফিস করতে খারাপ লাগতো। পত্রিকা হাউজে তো এ ধরনের বাধাধরা অফিস ছিলো না। তবে সাংবাদিকতা ছেড়ে এলেও আমরা কাজটা ছিলো মিডিয়া রিলেটেড। আমি জয়েন করেছিলাম পিআর-এর কাজে।

তখন অবশ্য পিআর ও মিডিয়া নিয়ে আলাদা কোনো ডিপার্টমেন্ট ছিলো না। কাজ করতে হতো মার্কেটিং বিভাগের সঙ্গে। আমি জয়েন করার কিছুদিন পর পর পিআরডি হয়। তবে কাজ করতে হতো উন্নয়ন ও শাখা সম্প্রসারণ বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে। এই ডিভিশনের ইনচার্জ ছিলেন খায়রুল বাশার। প্রথমদিকে আমি কাজ করেছি মির্জা মাহমুদ রফিকুর রহমানের সঙ্গে, তিনি পড়ে ইউসিবি ব্যাংকের এডিশনাল এমডি হয়েছিলেন।

পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট একটি স্পর্শকাতর ডিপার্টমেন্ট। এই বিভাগের মাধ্যমে ম্যানেজমেন্টের চাহিদা পূরণ করতে হয়। আবার মিডিয়াকেও সন্তুষ্ট রাখতে হয়। এই সমন্বয় কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়। অনেকে পিআর-এর মূল্য বুঝতে চায় না বা বোঝে না। অথচ ব্যাংকের প্রচার-প্রসারের সব কাজই নেপথ্যে থেকে করতে হয় পিআরডির লোকজনকে। ব্যাংকের নতুন ব্রাঞ্চ, নতুন প্রোডাক্ট, যেকোনো ইভেন্ট- এসব খবর মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে জানাতে হয়।

এসব প্রচার যতো বেশি হয়, আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে ততো সফল মনে করি। আবার নেতিবাচক কোনো খবর এলে- সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সময় কাটে খুব ব্যস্ততায়। থাকতে হয় অনেক চাপে। এ অবস্থা আরো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। ভালোমন্দ সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে। তবে সুখকর অভিজ্ঞতাই বেশি।

সিটি ব্যাংকের তিন দশকে আমি ৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমি চেয়ারম্যান হিসেবে পেয়েছি। তারা হলেন- দীন মোহাম্মদ, আনোয়ার হোসেন, ইব্রাহিম মিয়া, এমএ হাশেম, আজিজ আল কায়সার, রুবেল আজিজ ও মোহাম্মদ শোয়েব। কাজ করেছি ৯ জন এমডির সঙ্গে। তারা হচ্ছেন- এমএ ইউসুফ খান, কাজী বাহারুল ইসলাম, মো. তাহেরউদ্দিন, মোহাম্মদ ফয়েজ, আব্বাসউদ্দীন, ডিএইচ চৌধুরী (একটিং এমডি), কাজী মাহমুদ সাত্তার, সোহেল আর কে হুসেইন এবং মাসরুর আরেফিন।

সিটি ব্যাংকের অনেক বড় বড় কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এ বিষয়টি আমাকে গর্বিত করে। এরমধ্যে ২০০৮ সালে সিটি ব্যাংকের পুনর্গঠনের উদ্যোগ ছিলো বিশাল ব্যাপার। তখনো আমাদের লোগো চেঞ্জ করা হয়। বর্তমান এমডি মাসরুর আরেফিন তখন ছিলেন হেড অব রিটেইল ব্যাংকিং। তার নেতৃত্বে আমি লোগো পরিবর্তনের পুরো কাজটি তত্ত্বাবধানে ছিলাম।

২০০৪ সালে সিটি ব্যাংক প্রথম ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড চালু করে। এর প্রচারে কাজ করেছি। ১০ বছর আগে সিটি ব্যাংকের হাত ধরে আমেরিকান এক্সপ্রেস বা অ্যামেক্স কার্ড বাংলাদেশে আসে। এটা আমাদের দেশে এখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি গৌরববোধ করি। কারণ এর প্রচার-প্রচারণায় আমারও অংশগ্রহণ আছে।

২০ নভেম্বর আমার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। আবেগঘন দিন। এই দিনে সিটি ব্যাংকে জয়েন করি। ২৯ বছর ধরে এখানেই আছি। অনেক প্রস্তাব এলেও তা গ্রহণ করিনি। অনেকেই বলে থাকে, জাম্প করলে আমার নাকি আরো বেশি গ্রোথ হতো ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে। কিন্তু আমি কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে কখনোই মন থেকে সাড়া পাইনি।

সিটি ব্যাংকের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। এই ব্যাংক আর আমি যেন হরিহর আত্মা। এর স্বত্ত্বার সঙ্গে মিশে গেছি আমি। যেন রক্তের বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছি। পিআরও হিসেবে এখানে আমার শুরু। এখন হেড অব পাবলিক রিলেশনস অ্যান্ড মিডিয়া ডিভিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করছি।

সিটি ব্যাংকে আমার ২৯ বছর কেটে গেছে। অথচ মনে হচ্ছে, এই সেদিন জয়েন করেছি। শুরুতে আমাদের লেখালেখি করতে হতো টাইপ রাইটারে। টাইপ করার আগে কাগজে ড্রাফট করে নিতে হতো। হিসেবে করে ৩০-৩৫ কপি প্রিন্ট নিতাম। প্রেস রিলিজ মিডিয়া হাউজে দিয়ে আসতে হতো। এজন্য লোক পাঠাতাম। আবার নিজেও যেতাম। এখন কম্পিউটারে লিখে মেইল করে দিলেই হয়। আর সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে সার্বক্ষনিক মোবাইলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ তো আছেই।

আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের তিন দশকের যাত্রায় অসংখ্যা মিডিয়া হাউজ ও সাংবাদিক বন্ধুদের সহায়তা পেয়েছি। তারা আমার পাশে ছিলেন বলেই এই পেশায় সামনের দিকে যেত পেরেছি। আমার লাখ লাখ প্রেস রিলিজ তারা ছাপিয়েছেন। তাদের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।

পরিশেষে আবারো বলে রাখছি, সিটি ব্যাংকে আমার ব্যাংকি ক্যারিয়ার শুরু। শেষটাও হবে এই ব্যাংকে। প্রায় তিন দশকের যাত্রায় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের যারা আমার সহকর্মী ছিলেন তাদের সহায়তা ছাড়া আমার ক্যারিয়ার হয়তো দীর্ঘ হতে পারতো না। আমার মনে পড়ে আমিনুল ইসলাম সাহেবের কথা, তিনি ব্যাংকের সেক্রেটারি ছিলেন, আমাকে যথেষ্ট হেল্প করেছেন।

ব্যাংক এশিয়ার এএমডি হিসেবে কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন তিনি। আমাদের ডিএমডি ছিলেন নাজমুল কাদির, এখন আমেরিকায় থাকেন। আজিমপুরে তিনি আমার প্রতিবেশি ছিলেন বলে ব্যাংকে আমাকে আলাদা চোখে দেখতেন। এ. ই. আব্দুল মোহাইমেন আমাদের ব্যাংকে ডিএমডি ছিলেন, পরবর্তীতে ব্র্যাক ব্যাংক ও ইউসিবিএলের এমডি হয়েছিলেন, তার কথাও মনে পড়ছে। তার সঙ্গে ২ বছর সরাসরি কাজ করেছি। আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের তথা সিটি ব্যাংকের সবার প্রতি শুভ কামনা ও ভালোবাসা। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।